৮ আগস্ট বুধবার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ
বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম
ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন। ১৯৩০ সালের এ দিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া
গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে জাতির জনকের
হত্যাকারীদের নিষ্ঠুর, বর্বরোচিত
হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা
মুজিব মাত্র তিন বছর বয়সে পিতা ও পাঁচ বছর বয়সে মাতাকে হারান।
তাঁর ডাক নাম ছিল
রেনু। পিতার নাম শেখ জহুরুল হক ও মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। দাদা শেখ কাসেম চাচাত
ভাই শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেগম ফজিলাতুন্নেছার বিবাহ
দেন। তখন থেকে বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে শ্বাশুড়ি বঙ্গবন্ধুর মাতা সাহেরা খাতুন নিজের
সন্তানদের সঙ্গে মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে তিনি প্রাথমিক
লেখাপড়া করেন। অতঃপর সামাজিক রীতি-নীতির কারণে গ্রামে গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া
করেন। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল ও পাঠ্য বইয়ের বাইরে
প্রচুর পড়াশোনা করতেন। টুঙ্গীপাড়া গ্রামে শেখ বাড়িতে পরিবারের ছেলেমেয়েদের
ধর্মীয় শিক্ষাদানের জন্য মৌলভী এবং বাংলা, ইংরেজি
ও অংক শিক্ষার জন্য গৃহশিক্ষক রাখার রেওয়াজ ছিল। পরিবারের সকল শিশু-কিশোর বিশেষ
করে মেয়েরা বাড়িতেই শিক্ষা গ্রহণ করতো।
আমরা শোকাহত |
বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের স্মৃতি শক্তি
অত্যন্ত প্রখর ছিল। মনেপ্রাণে একজন আদর্শ বাঙালি নারী ছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, শান্ত, অসীম
ধৈর্য ও সাহস নিয়ে জীবনে যে কোন পরিস্থিতি দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করতেন। তাঁর
কোন বৈষয়িক চাহিদা ও মোহ ছিল না। স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে
সর্বাত্মকরণে সহযোগিতা করেছেন।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল। অর্থনৈতিক
ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ মানুষদের মুক্তহস্তে দান করতেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের
রোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, কারাগারে
আটক নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবরাদি নেওয়া ও পরিবার-পরিজনদের যে কোন সংকটে পাশে
দাঁড়াতেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে অর্থ সাহায্য করা ও শিক্ষার জন্য সহযোগিতা
সবসময়ই করতেন। তাঁর অপত্য স্নেহ, মমতা, দরদ, আপ্যায়নের
কথা আজও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা যে যে অবস্থানেই থাকুন না কেন, অকৃত্রিম শ্রদ্ধার সাথে তা স্মরণ করেন।
ইতিহাসে তাই বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেবল একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়কের
সহধর্মিনীই নন; বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে অন্যতম এক স্মরণীয়
অনুপ্রেরণাদাত্রী।
বঙ্গবন্ধু ব্যস্ত থাকতেন রাজনীতি নিয়ে; সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করা, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা, লেখাপড়ার সব দায়িত্বই তিনি নিজের হাতে
নিয়েছিলেন; আত্মীয়-স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীদের
সুখ-দুঃখের সাথী ছিলেন তিনি। স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সন্তানদের গড়ে
তোলেন। তাঁর কাছ থেকে সহযোগিতা চেয়ে কেউ কখনো রিক্ত হাতে ফিরে যেত না।
অনাথ-এতিমদের তিনি সবসময় অপার মাতৃস্নেহে ভালবাসতেন ও সহযোগিতা করতেন।
রাজনৈতিক জীবনের অনেক জটিল সংকট পরিস্থিতিতে
স্বামীর পাশে থেকে সৎ পরামর্শ দিতেন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করতেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র
মামলা দায়ের করার পর তদানীন্তন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন্নেছা
মুজিবকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করে গ্রেফতারের হুমকি দেয়।
বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলনের
প্রতি পদক্ষেপে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন; ছায়ার
মতো অনুসরণ করেছেন স্বামীর আদর্শকে বাস্তবায়ন করবার জন্য; জীবনে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন, অনেক কষ্ট, দুর্ভোগ
তাঁকে পোহাতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় কারান্তরালে কাটিয়েছেন
বছরের পর বছর। তাঁর অবর্তমানে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করতে সহায়তা করা, আন্দোলন পরিচালনায় পরামর্শ দেওয়াসহ
প্রতিটি কাজে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে
প্রতিটি ঘটনা জেলখানায় সাক্ষাৎকারের সময় বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন এবং প্রয়োজনীয়
পরামর্শ ও নির্দেশ নিয়ে আসতেন, আওয়ামী
লীগ ও ছাত্রলীগকে সে নির্দেশ জানাতেন, নেপথ্যে
থেকে তিনি ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি পুলিশ ও গোয়েন্দা
সংস্থার চোখ বাঁচিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং
প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। এই সংগঠনের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি
অনুপ্রেরণা, শক্তি, সাহস, মনোবল ও প্রেরণা যুগিয়েছেন জাতির জনক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হানাদার বাহিনীর চোখ এড়িয়ে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ জামাল, শেখ রাসেল প্রমুখ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে আত্মগোপন করেন। কিন্তু পাক বাহিনী ক্ষিপ্ত হায়েনার মতো তাঁদের খুঁজে বেড়ায়। এ পাড়া ও পাড়া এবং এ বাড়ি ও বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে কিছুদিন থাকলেও শেষাবধি পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দারা তাদেরকে মগবাজারের একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। অতঃপর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে পরিবারের অপরাপর সদস্যদের সঙ্গে ধানমন্ডির ১৮নং সড়কের একটি বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। চরম মানসিক পীড়ন ও ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। কিন্তু স্বামীর বন্দিদশা এবং পাকিস্তানের কারাগারে তাকে হত্যার আশঙ্কা সর্বোপরি নিজেদের বন্দিত্ব ও নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি মুহূর্তের জন্যও ভেঙে পড়েননি; মাথানত করেননি। অসীম মনোবল, সাহস ও ধৈর্য্য নিয়ে তিনি পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় এবং পাক বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর তাদের বন্দিদশার অবসান ঘটে। কিন্তু তারপরও বিজয়ের আনন্দ তিনি অনুভব করতে পারেননি। অপেক্ষা করতে হয়েছে এবং দেশবাসীকেও ধৈর্য্য ধারণের জন্য পরামর্শ দিতে হয়েছে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডনে যান। সেখান থেকে বেগম মুজিবের সঙ্গে তাঁর প্রথম কথা হয়। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার দীর্ঘ প্রতিক্ষার। বাঙালি জাতি ফিরে পায় তাদের অবিংসাদিত প্রিয় নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু
যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। তাঁর পাশে থেকে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, সংসার গড়ার পাশাপাশি বিধ্বস্ত দেশ গড়ার
কাজেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সহযোগিতা করতে সচেষ্ট হলেন বেগম মুজিব। বিশেষ
করে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক লাঞ্ছিত মা-বোনকে সহযোগিতা ও তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা
করা, ব্যক্তিগতভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সান্তনা
দেওয়া; সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ
নেন। ধীরে ধীরে তিনি অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন
জীবনদান করেন।
এই মহীয়সী নারী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত
বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেশ ও জাতির সেবা করে গেছেন। জনগণের জন্য সমগ্র জীবন তিনি
অকাতরে দুঃখবরণ করেছেন এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির
জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার সময় পরিবারের অপরাপর সদস্যদের সাথে
বেগম মুজিবকেও মানবতার শত্রু, ঘৃণ্য
ঘাতক, দুশমনের দল নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।
বঙ্গবন্ধুর আজীবন সুখ-দুঃখের সঙ্গী মৃত্যুকালেও তার সঙ্গী হয়ে রইলেন।