আমার অভিজ্ঞতায় মুক্তিযুদ্ধ এবং ৭ই মার্চের ভাষন
মে 14, 2008 by nasarchoudhury
আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু সবসময় ঠাট্টাচ্ছলে বলে থাকে “দোস্ত তোর জন্য আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তুই যদি সেদিন জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষন রেকর্ড করে প্রচার না করতিস, তবে দেশের লোক বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক শুনতেই পেতো না, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতও হতো না।” তবে আমি বলি ঠিক তা
না,বাংলাদেশের স্বাধীনতা নয় মাসের মুক্তিযোদ্ধা
মুক্তি সংগ্রামী মানুষের ত্যাগের জন্যই এসেছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব থেকেই পট পরিবর্তনের প্রস্তুতি
চলছিলো। এবং এক্ষেত্রে জনমত তৈরীতে তত্কালীন রেডিও শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে আসছিলো।
আমি তখন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকার অনুষ্ঠান সংগঠকের পদে
কার্জরত। আমার দায়িত্ব ছিল রেডিওর বাইরের সকল অনুষ্ঠান রেকর্ড করে প্রচারের
ব্যবস্থা করা। আমার সঙ্গে অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসাবে কাজ করতো মীর রায়হান।
ইলেকশানে জেতার পর শেখ মজিবুর রহমানের পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা, কিন্তু সবাই বুঝতে
পারছিল পশ্চিম পাকিস্তানীরা কিছুতেই সেটা হতে দেবে না। সেটা আঁচ করতে পেরেছিলেন
বঙ্গবন্ধু এবং ছাত্র নেতারা। তখন থেকেই অসহযোগ আন্দোলনের ভূমিকা তৈরী হতে শুরু
করলো।
রেডিও পিছিয়ে থাকলো না। আমরা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হিসাবে ‘রেডিও পাকিস্তান ঢাকা’-র নাম পরিবর্তণ করে ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ রাখলাম,এবং এই নামে প্রচার শুরু করে দিলাম। সে সময়
এতবড় পদক্ষেপ নেয়া যে কত সাহসের কাজ ছিলো, এখন তা বুঝতে পারি। রেডিওর অনুষ্ঠান, বার্তা, এবং প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, এক কথায় সমগ্র রেডিওর কর্মকর্তা কর্মচারীর সহযোগীতা ছাড়া যা কিছুতেই করা সম্ভব
ছিল না।
এই সাহসিকতা করার পিছনে বিশেষভাবে যাঁদের নাম করতে হয়,তারা হলেনঃ
জনাব আশরাফুজ্জামান খান - পরিচালক
জনাব আহমাদুজ্জামান - সহকারী পরিচালক
জনাব মবজুলুল হোসেন - সহকারী পরিচালক
জনাব মফিজুল হক - সহকারী পরিচালক
জনাব সাইফুল বারি - বার্তা পরিচালক
জনাব জালালউদ্দীন রুমী - অনুষ্ঠান সংগঠক
জনাব আশফাকুর রহমান - অনুষ্ঠান সংগঠক
জনাব তাহের সুলতান - অনুষ্ঠান সংগঠক
জনাব শামসুল আলম - অনুষ্ঠান সংগঠক
জনাব কাজী রফিক - অনুষ্ঠান সংগঠক
জনাব বাহরামউদ্দীন সিদ্দিকী - অনুষ্ঠান সংগঠক
জনাব মীর রায়হান - অনুষ্ঠান প্রযোজক
জনাব ফয়েজ আহমদ চৌধূরী - সহকারী বার্তা
পরিচালক
এবার আসি ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষন প্রসঙ্গে।
প্রচার করা হলো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষন সরাসরি ঢাকা বেতার কেন্দ্র প্রচার করবে
তত্কালীন রেস কোর্স ময়দান থেকে। সব ব্যাবস্থা নেয়া হলো।
পরিচালক আশরাফুজ্জামান খান সব রেডিওর কর্মচারীদের দায়িত্ব
বুঝিয়ে দিলেন। রেসকোর্স মাঠে মঞ্চের উপরে পরিচালক আশরাফুজ্জামান, সহকারী পরিচালক আহমাদুজ্জামান এবং আমি নাসার আহমেদ চৌধুরী থাকবো। প্রকৌশল
বিভাগ থেকে জনাব সামাদ সাহেবের নাম মনে পড়ে।
মঞ্চের নিচে জনাব শামসুল আলম, কাজী রফিক, রেডিওর ডিউটি রুমে বাহরামউদ্দিন সিদ্দিকী, সাভার প্রচার কেন্দ্রে প্রকৌশল বিভাগের কর্মচারীর সঙ্গে মীর রায়হান।
সকাল থেকেই ঘন ঘন প্রচার করা হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষন সরাসরি
রেসকোর্স মাঠ থেকে প্রচার করা হবে। রেসকোর্স মাঠে লোকে লোকারণ্য, তিল ধারণের জায়গাও ছিল না। আমরা বেশ আগেই মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোন সেট করে
ফেললাম। আমি আমার সঙ্গে নিলাম পোর্টেবল ই.এম.আই. টেপ রেকর্ডার।
নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে বঙ্গবন্ধু মাঠে এলেন। সেই সময়
আকাশে প্লেন দেখা গেল। সেই প্লেনে লেঃ জেনারেল টিক্কা খানের আসার কথা, সারা মাঠে উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠে ভাষন শুরু করতে যাবেন।
এমন সময় রেডিওর ডিউটি রুম থেকে ইন্টারকমের মাধ্যমে বাহরাম সিদ্দিকী মঞ্চে আমাদেরকে
জানালো যে এই মাত্র মেজর সিদ্দিক সালেক জানিয়েছেন, কোনমতেই শেখ মুজিবুরের ভাষন রেকর্ড করা যাবে না, প্রচার করলে রেডিও উড়িয়ে দেয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি প্রচার বন্ধ করে দেয়া
হলো। বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক বর্ক্তিতা শুরু করে দিয়েছেন, আমি আমার সাথে ছোট্ট টেপ রেকর্ডারে রেকর্ডিং শুরু করে দিলাম। সহকারী পরিচালক
আহমাদুজ্জামান একটি ছোট্ট চিরকুটে “আর্মি ভাষন
প্রচার করতে দিচ্ছে না” লিখে মঞ্চে উপবিষ্ট
পরিচালক আশরাফুজ্জামানের হাতে দিলেন। আশরাফুজ্জামান সাহেব সেটা টাঙ্গাইলের
এম.পি.-র (আমার এখন নাম মনে পড়ছে না) হাতে দিলেন। তখন
বর্ক্তৃতা অনেকখানি প্রচার হয়ে গেছে। তিনি বঙ্গবন্ধুর হাতে চিরকুটটি পৌছে দিলেন।
আপনারা যারা বর্ক্তৃতা শুনেছেন, তাদের মনে থাকার কথা বর্ক্তৃতার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “…এই মাত্র খবর পেলাম তারা আমার বর্ক্তৃতা প্রচার করতে দিচ্ছে না। রেডিও
টেলিভিশনের কর্মচারীরা আপনারা কাজে যাবেন না যতক্ষণ না আমার ভাষন প্রচার করতে দেয়।
অফিস আদালত সব বন্ধ করে দেয়া হলো। …এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার
সংগ্রাম।”
সারা মাঠে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। আমি দু’টো টেপে সমগ্র ভাষন রেকর্ড করে নিলাম। ভাষন শেষে টেপ দু’টো সাবধানে আমার সার্টের ভিতরে লুকিয়ে ফেললাম এবং দ্রুত
মঞ্চ থেকে টেপ রেকর্ডার, স্ট্যান্ড নিয়ে নিচে
নেমে পড়লাম। তখন লোক যে যেদিকে পারছে ছুটে যাচ্ছে।
নিচে আলম, কাজী রফিকের সঙ্গে
দেখা হলো। পরিচালক সাহেবকে আমি গোপনে রেকর্ড করেছি জানালাম। তিনি আমার প্রশংসা
করলেন এবং মাঠে যুগ্ম সচিব সাহেবকে জানালেন এবং প্রশ্ন রাখলেন এখন আমরা কি করবো।
যুগ্মসচিব জহরুল হক সাহেব জানালেন আপনারা সবাই পালিয়ে যান। কেউ নিজের বাসায় যাবেন
না। রেডিও বন্ধ করে দিন, কেউ জিজ্ঞেস করলে
আমার কথা বলবেন।
হাতিরপুলে কাজী রফিকের বাসায় আমরা সবাই গিয়ে উঠলাম। এবং সেখান থেকে
ডিউটি রুমে, সাভার ট্রান্সমিটারে জানানো হলো সব প্রচার বন্ধ করে পালিয়ে যাও। কিছুক্ষণের
মধ্যেই সারা দেশের রেডিও প্রচার বন্ধ হয়ে গেল।
রেডিও প্রচার বন্ধ হলে দেশের যে কি অবস্থা হয়, বুঝতে পারলাম। আমাদের চেয়ে বেশি বুঝতে পারলো পশ্চিম পাকিস্তানীরা। পূর্ব এবং
পশ্চিমের একমাত্র লিংক ছিল রেডিও। তারা অস্থির হয়ে উঠলো পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটছে
তা জানার জন্যে। সারা রাত আমরা কাজী রফিকের বাসায় কাটালাম। ইতিমধ্যে আর্মি আমাদের
পরিচালক সাহেবকে খুঁজে পেল, এবং তার কাছে
পুরোপুরি সারেন্ডার করলো। এই ছিল পাকিস্তান আর্মির প্রথম আত্মসমর্পন। তারা
আশরাফুজ্জামানকে জানালো, “আপনারা যা চান, যেভাবে চান পুরো ভাষন প্রচার
করুন,কিন্তু খোদার ওয়াস্তে রেডিও প্রচার চালু করুন।
পশ্চিম পাকিস্তান সরকার সবাই অস্থির হয়ে গেছে।”
আশরাফুজ্জামান সাহেব এসে আমাদের জানালেন, “আমাদের জয় হয়েছে। আর্মি পুরোপুরি আমাদের কাছে সারেন্ডার
করেছে। আমি তাদের বলে দিয়েছি কাল সকালের আগে রেডিও চালু হবে না, এবং বঙ্গবন্ধুর ভাষন পুরোপুরি প্রচার করতে দিতে হবে। তারা রাজি হয়েছে।”
আশফাকুর রহমান খান পূর্ব ঘোষনা লিখে ফেললেন। প্রকৌশলী
সবাইকে জানিয়ে দেয়া হলো সকালে রেডিও খোলা হবে।
সকাল থেকে ঘন ঘন ঘোষনার পরে আমার রেকর্ড করা সেই টেপ দু’টো বাজানো হলো। পূর্ব পাকিস্তানের সব অঞ্চলের লোক সেই ভাষন
শুনে বুঝতে পারলো স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয়েছে। তারা সবাই স্বাধীনতার প্রস্তুতি নিতে
শুরু করলো।
এর পর বঙ্গবন্ধুর ইঞ্জিনিয়ারিং হলের ভাষন, ২৩শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং বাসায় দেয়া ভাষন, সব রেকর্ড করে প্রচার করা হলো।
তার পর এলো সেই বিভীষিকাময় ২৫শে মার্চের রাত।
এর পূর্বে শেরাটন হোটেলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, ভূট্টো এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে দর কষাকষি শুরু হয়েছে। আসলে তারা সময়
নিচ্ছিল, সিভিলিয়ান ড্রেসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্লেনে আর্মি আনার। এমনও কথা শুনা গেল
ভুট্টো চাইছেন শেখ মুজিব হবেন পূর্ব পাকিস্তানের এবং ভুট্টো হবেন পশ্চিম
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। এমন অবাস্তব প্রস্তাবে শেখ মুজিব রাজী হলেন না। কোন
মিমাংশা ছাড়াই ইয়াহিয়া ভুট্টো রাত ৮টা-৯টার দিকে ফিরে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে।
রাত ১২টার পর দেখতে পেলাম রাস্তা দিয়ে একের পর এক আর্মির
ট্যাঙ্ক রেডিও অফিস এবং অন্যান্য জায়গায় এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু জানার আগেই
গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। তারা যাকে যেখানে পেল গুলি করে মেরে ফেললো। সকালে জানা গেল
ইত্তেফাক অফিস,রাজারবাগ পুলিশ লাইন, বি ডি আর পিলখানা সব জায়গায় গোলাগুলি চলছে।
সকাল ৯টার দিকে আর্মি কমান্ড থেকে রেডিওর কর্মচারীদের
রেডিওতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধুর কোন খবর পাওয়া গেল না, বেঁচে আছেন না নেই কেউ কিছু জানে না।
রেডিওতে আমরা কাজ শুরু করলাম। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে
গেল।
ঢাকা রেডিও থেকে তাহের সুলতান, আশফাকুর রহমান, আশরাফুল আলম, আরও অনেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেয়ার জন্য সীমান্তের ওপারে চলে
গেল।
আমরা রেডিওতে থেকে সহযোগীতা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। আমার
সহকর্মী জালালউদ্দিন রুমি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য রেডিও ছেড়ে দিল।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে পাঠানোর জন্য আমি এবং ফয়েজ
চৌধুরী গণসঙ্গীত এবং দেশাত্ববোধক গানের টেপ নিয়ে বাসে করে আর্মির চোখকে ফাঁকি দিয়ে
নারায়নগঞ্জে জালালউদ্দিনের কাছে দিয়ে আসতাম। রাস্তায় কতবার আর্মি আমাদের সার্চ
করতো তার হিসাব ছিল না। যেহেতু আমি বহির্প্রচার বিভাগে কর্মরত ছিলাম, তাদেরকে বলতাম “নারায়নগঞ্জ আদমজী
জুট মিলে কাজটাজ ঠিকমতো চলছে, দেশে স্বাভাবিক
অবস্থা বিরাজ করছে এগুলো রেকর্ড করতে যাচ্ছি।” তারা বুঝতে পারতো না। ছেড়ে দিত।
রেডিওর পরিচালক আশরাফুজ্জামানকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় সৈয়দ
জিল্লুর রহমান সাহেবকে আনা হলো। জিল্লুর রহমান সাহেব আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন
তার কক্ষে আমার ডাক পড়লো। সেখানে গিয়ে দেখি একজন আর্মি অফিসার বসে আছেন।
জিল্লুর রহমান সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ইনি কর্ণেল কাশেম,তোমার বিরুদ্ধে ইনার কিছু অভিযোগ আছে। তুমি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিশে দেশ
দ্রোহীতার কাজ করছো।” আমি সুবোধ বালকের
মতো অস্বীকার করলাম।
কর্ণেল কাশেম তখন সরাসরি আমাকে প্রশ্ন শুরু করলেন। “তুমি আওয়ামী লিগ কর। ৭ই মার্চের ভাষন তুমি রেকর্ড করেছিলে, এবং তুমি মঞ্চে শেখ মুজিবকে তার ভাষন প্রচার করতে দিচ্ছে না লিখে জানিয়েছিলে।” আমি বললাম, “না, আমি লিখিওনি কাউকে
জানাইও নি।”
তখন জিল্লুর রহমান আমাকে বাঁচানোর জন্যে বললেন, “He
is a petty officer, whatever he does he does with the permission of his
director.”
তখন কর্ণেল কাশেম তার ব্রিফকেস খোলার ভান করে আমাকে বললেন, “আমার কাছে তোমার ছবি আছে, মঞ্চে তুমি শেখ মুজিবকে চিরকুট দিচ্ছো।” যেহেতু আমি দেই নাই, তাই সাহসের সঙ্গে
বললাম, “না আমি দেই নাই।” তখন কর্ণেল আর ব্রিফকেস খুললেন না। জিল্লুর রহমান সাহেব বললেন, “সে Govt অফিসার, সে কোন পার্টি করে না,আমি তাকে খুব
ভালভাবে জানি।”
জিল্লুর রহমান সাহেবের কথায় কর্ণেল কিছুটা আস্বস্ত হলো।
বললো “ঠিক আছে, তুমি যা যা করেছো এবং যা যা জানো, একটা কাগজে লিখে
আমার কাছে নিয়ে এসো।” আমি আসল কথা গোপন করে মিথ্যে যা
যা পারলাম লিখে দিলাম। কর্ণেল চলে গেলেন।
জিল্লুর রহমান সাহেব আমার মামার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। মামা
জনাব আলি হাসান সিএসপি, তখন পাকিস্তানের communication
secretaryছিলেন। দু’জনে মিলে সেইদিনই আমাকে চট্টগ্রাম রেডিওতে বদলী করে দিলেন, এবং আমাকে বললেন, “তোমার নাম আর্মির
লিস্টে আছে। যে কোন মুহুর্তে তোমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাবে এবং নঁখের ভিতরে সুঁই
ফুটিয়ে কথা বের করে নেবে। তাই আজই তুমি চিটাগাং চলে যাও, আমরা এদিক সামলে নেব।”
চট্টগ্রাম রেডিওতে গিয়ে জয়েন করলাম, কিন্তু সেখানে আমাকে কোন দায়িত্ব দেয়া হলো না। O.S.D করে রাখা হলো। হয়তো
ঢাকা রেডিও থেকে আগাম জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, তাই সবাই আমাকে একটু এড়িয়ে চলছে বুঝতে পারলাম।
কোন উপায় না দেখে ঢাকার বার্তা বিভাগের ফয়েজ চৌধুরীকে ফোন
করলাম, “Mother serious come sharp লিখে একটা টেলিগ্রাম
পাঠিয়ে দে। আমার এখানে ভাল লাগছে না, আমি ঢাকায় চলে আসি।”
দু’দিনের মধ্যেই
টেলিগ্রাম পেয়ে গেলাম। সেটা ছিল ৭১ সালের অগাস্ট মাস। বহু কষ্টে টেলিগ্রাম দেখিয়ে
সাতদিনের ছুটি নিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। এসে দেখি রেডিওর গেটে জানিয়ে রাখা হয়েছে আমাকে
যেন ঢুকতে দেয়া না হয়।
আমি রেডিওর সামনে সাহবাগ হোটেল, বর্তমান PG হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আলম, রফিক, ফয়েজ সবাই এসে আমার সঙ্গে দেখা করতো। তারা টেপ দিলে আমি যথারীতি নারায়নগঞ্জে
জালালের কাছে নিয়ে যেতাম।
সেই যে চট্টগ্রাম থেকে এসেছিলাম, আর ফিরে যাইনি। আমার স্কুল জীবনের বন্ধু সিরাজউদ্দীন ভুইঞা মুক্তিযুদ্ধের
সক্রিয় কর্মী ছিল। সে কখন কোথায় বোমা ফাটাতো আমার সঙ্গে আলাপ করতো। যেমন “আজ শেরাটন হোটেলে, কাল আজিমপুর গার্লস
স্কুলে বোমা ফাটাবো।”এইভাবে
মুক্তিযোদ্ধারা অস্থির করে তুলেছিল সমগ্র দেশের ব্যবস্থাপনা।
একটা মজার ঘটনা হঠাৎ মনে পড়ছে। তখনও আমি
রেডিওর ঢাকা অফিসে দায়িত্বরত। মুক্তিযোদ্ধারা বোমা মেরে ঢাকা বিমান বন্দরের রানওয়ে
নষ্ট করে দিয়েছে, সব বিমান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে
গিয়েছিল। হঠাৎ একটি বিমান রিলিফ সামগ্রী নিয়ে কোনমতে একটা রানওয়েতে নেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে
সরকারের তরফ থেকে জানানো হলো সমস্ত প্রচার মিডিয়া এটা সগৌরবে প্রচার করবে, যে এয়ারপোর্টে কিছুই হয়নি। সবই ঠিকমতো চলছে।
আর্মির ক্যাপটেন সব খবরের কাগজের সাংবাদিকদের এবং রেডিও
থেকে আমাকে নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে হাজির হলেন। আমাদেরকে দূর থেকে এয়ারপ্লেন দেখিয়ে
বললেন “আপনারা যান এবং প্রতিবেদন তৈরী করুন। সারা
পৃথিবীকে জানিয়ে দিন দেশের অবস্থা ভাল, এয়ারপোর্টের অবস্থা
ঠিকই আছে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের propaganda সব মিথ্যা।”
জনাব এ.বি.এম. মুসা সবার আগে, পিছে পিছে আমরা প্লেনের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ পশ্চিম পাকিস্তানী
এক আর্মির সিকিউরিটি গার্ড আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলো, “কিধার যাতা হ্যায়?”
মুসা সাহেব বললেন, “ও প্লেন কে পাস যাতা হ্যায়। উসকা পাইলট কে সাথ বাতচিত কারেগা, নিউজ পেপার মে ছাপেঙ্গে।”
“নিউজ পেপার, ও কিয়া হোতা হ্যায়?”, জিজ্ঞেস করলো আমাদের।
ভাবলাম ভাল লোকের পাল্লায় পড়া গেছে। মুসা সাহেব তাকে
বুঝাবার জন্য বললেন, “ও যো জংগ খাবর কা
কাগজ (যা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হতো), উস তারহা ইঁহাকা কাগজ মে ছাপেগা।”
সে অন্য কোন কথাই বুঝলো না, শুধু জংগ কথাটা ধরে বললো, “ইহা কোই জংগ-ওয়ং নেহি চালেগা, ভাগো।”
আমি ভাবলাম আমাকে হয়তো যেতে দেবে। আমি রেডিও পাকিস্তানের
কর্মচারী, হাতে টেপ রেকর্ডার। তার কাছে গিয়ে বললাম, “হাম রেডিও পাকিস্তান সে আয়া হ্যায়।”
আমার দিকে তাকিয়ে বললো “ও কোন সা পাকিস্তান হ্যায়? ইহা এক পাকিস্তান হ্যায়, দুসরা কোই পাকিস্তান
নেহি - যাও ভাগো।”
আমরা সবাই ফিরে এলাম, কিছুতেই যেতে দিল না। মুসা সাহেব বললেন আমি এর প্রতিবাদ করবো। পরের দিন খবরের
কাগজে ঠিকই বিমান অবতরণের কথা ছাপা হলো, কিন্তু প্রতিবেদন না
করতে দেয়ার প্রতিবাদ সহ।
বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতায় ১৯৭১ এর ৩রা ডিসেম্বর
ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করলো। আমরা আমাদের ধানমন্ডির বাসার ছাঁদে
উঠে আকাশে ভারতীয় মিগ আর পাকিস্তানের সেবার জেটের মধ্যে সামনা সামনি যুদ্ধ দেখতাম।
মিগের গতির সঙ্গে কিছুতেই সেবার জেট পেরে উঠতো না। সেবার জেটগুলো একের পর এক গুলি
খেয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে নিচে পড়ে যেত। অনেক বাড়ির ছাঁদের উপর থেকেই সেবার
জেটের প্রতি লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হতো।
৭ই মার্চ যেই রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক
দিয়েছিলেন,সেই একই ময়দানে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী
তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলো সম্মিলিত বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পন করে। যে অত্যাচার
অবিচার তারা করেছিল, সব কিছুর সমাপ্তি টানা হলো।
জন্ম নিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষনের সেই অমূল্য টেপ দু’টো যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে
নিয়মিত প্রচার করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য।
porshigaanraj@gmail.com
No comments:
Post a Comment